ভূমিকা
প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের সাথে সাথে অটোমোবাইলের বিভিন্ন প্রযুক্তিতেও নানা ধরনের অগ্রগতি হচ্ছে। আগে বিভিন্ন লেখায় আমি বলেছি যে ১৮৮৬ সালে গাড়ি উদ্ভাবনের পর থেকে যেমন মানুষ কাজ করেছে উন্নত ও নতুন মডেলের গাড়ি তৈরীতে, তেমনই মানুষ কাজ করেছে কিভাবে গাড়িকে আরও নিরাপদ করা যায় যাতে করে দূর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচা সম্ভব অথবা দূর্ঘটনা ঘটে গেলেও হতাহতের হার কমানো ও যাত্রীকে নিরাপদে রাখা যায়।
বর্তমানে অটোমোবাইলের সেফটি সিস্টেমে দুই ধরনের সিস্টেম বা পদ্ধতি দেখা যায়। একটি হলো এক্টিভ সেফটি সিস্টেম এবং অন্যটি হলো প্যাসিভ সেফটি সিস্টেম। এই লেখাতে আমি এক্টিভ সেফটি সিস্টেম নিয়ে আলোচনা করবো।
এক্টিভ সেফটি সিস্টেম কি?
এক্টিভ সেফটি সিস্টেম গাড়িতে দূর্ঘটনা ঘটার আগে সক্রিয় থাকে। এধরনের সিস্টেম গাড়ির দূর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে কাজ করে। এমনকি দূর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী হলেও এক্টিভ সেফটি সিস্টেম কাজ করে যাতে দূর্ঘটনার প্রভাব হ্রাস করা যায়। ধরা যাক, একটি গাড়ি ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলছে, গাড়িটি সামনে চলমান একটি গাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এলো। এমতাবস্থায় এমন হতে পারে যে কোনভাবে দূর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু পন্থায় ক্ষয়ক্ষতি কমানো যেতে পারে। এক্টিভ সেফটি সিস্টেম এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এমার্জেন্সি ব্রেক ব্যবহারের মাধ্যমে। এছাড়াও, এক্টিভ সেফটি সিস্টেমকে প্রাইমারী সেফটি সিস্টেমও বলা হয়। এক্টিভ সেফটি সিস্টেমের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই অটোনোমাস কার বা সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির উন্নয়ন বা গবেষণা চলছে।
এক্টিভ সেফটি কিভাবে কাজ করে?
সবকিছুরই কাজ করার একটি পদ্ধতি বা সিস্টেম থাকে। মানুষ এমনকি কম্পিউটার, বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র সব। মজার ব্যাপার হলো আমরা মানুষরা যেই পদ্ধতিতে কোনো কাজ করি, কম্পিউটার বা যন্ত্রের কাজ করার পদ্ধতিও প্রায় এক। শুধু পার্থক্য হলো আমাদের জীবন আছে, যন্ত্রের তা নেই। যন্ত্র বা কাজ করে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও কিছু এলগোরিদম ব্যবহার করে। এলগোরিদম কি তা কিছুক্ষন বাদেই আমরা জানবো। প্রথমেই আমরা জেনে নেই মানুষ কাজ করে কিভাবে?
একটা সহজ উদাহরন দিয়ে বুঝাই। ধরা যাক, আপনার ফোন আপনার পাশে টেবিলে রাখা। ফোনটি বেজে উঠলো, আপনি রিং শুনতে পেলেন এবং চোখ দিয়ে দেখলেন আপনার ফোনে কলারের নাম সহ “কলিং” লেখাটি উঠেছে। আপনি এরপর ধরা যাক সেকেন্ডখানেক ভাবলেন। এরপর হয় ফোনটি ধরলেন, অথবা কেটে দিলেন অথবা, ফোন যেভাবে ছিলো সেভাবেই রেখে দিলেন, এরপর রিং শেষ হয়ে গেলো।
এখানে আপনার প্রতিটি কাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কম্পিউটারের সিস্টেম ইনপুট, সিপিইউ, আউটপুটের সাথে তুলনা করলে, প্রথমে আপনি ফোনকল দেখতে পেলেন এবং রিং শুনতে পেলেন, এটি হলো ইনপুট, এরপর আপনি যে সেকেন্ডখানেক ভাবলেন যে কি করবেন, সেটি মূলত করছে আপনার মস্তিষ্ক, এই কাজটি হলো কম্পিউটারের সিপিইউ এর কাজের মত। এরপর আপনি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলেন, এবং হয় ফোন ধরলেন নাহলে কেটে দিলেন। এটি কম্পিউটারের আউটপুটের মত।
এখন প্রশ্ন হলো, এক্টিভ সেফটি সিস্টেমও কি এভাবে কাজ করে? হ্যা। তারা কাজ করে সেন্সর, বিভিন্ন এলগোরিদম ও একচুয়েটর এবং হিউম্যান মেশিন ইন্টারফেস ও একচুয়েটরের সাহায্যে। এক্টিভ সেফটি সিস্টেমে সেন্সর কাজ করে মানুষের চোখের মত। আমরা যেমন চোখ দিয়ে কিছু দেখি এবং মস্তিষ্ক খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেই যে কি করবো, তেমনই সেন্সর গাড়ির চারপাশের অবস্থা, প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি সনাক্ত করে এবং সে সংক্রান্ত তথ্য গাড়ির সেফটি সিস্টেমের কন্ট্রোল ইউনিটে চলে যায় এবং বিভিন্ন এলগোরিদমের সাহায্যে সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার কাজ হয়। প্রশ্ন জাগতে পারে, এলগোরিদম কি?
কোনো কাজ সম্পন্ন করবার জন্য প্রয়োজনীয় ধাপগুলোকে একসাথে এলগোরিদম বলে। আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিটা কাজ করতে কোনো না কোনো এলগোরিদম অনুসরণ করি। যেমন, একজন রাস্তা পার হতে চাইলে তাকে দেখতে হবে ওভারব্রিজ আছে কিনা, না থাকলে ডানে, বামে কয়েকবার দেখে যদি গাড়ি থাকে তাহলে অপেক্ষা করতে হবে, ফাঁকা থাকলে সামনে এগুতে হবে। এভাবেই নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করা, আর বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়াই এলগোরিদম। মানুষের মস্তিষ্ক, কম্পিউটার বা যন্ত্রাংশ, যেকোনো কিছু চলতেই এলগোরিদম এর প্রয়োজন।
এলগোরিদমের মাধ্যমে প্রক্রিয়ার কাজ শেষে সিদ্ধান্ত চলে যায় হিউম্যান মেশিন ইন্টারফেস অথবা একচুয়েটরে। এবং সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হিউম্যান মেশিন ইন্টারফেস ও একচুয়েটর কাজ করে এবং এক্টিভ সেফটির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে।
এক্টিভ সেফটি সিস্টেমের প্রকারভেদ
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের এক্টিভ সেফটি সিস্টেম দেখা যায়, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - এন্টি লক ব্রেকিং সিস্টেম, ইলেক্ট্রনিক স্টেবিলিটি কন্ট্রোল, অটোনোমাস এমার্জেন্সি ব্রেকিং, এডাপ্টিভ ক্রজ কন্ট্রোল, টায়ার প্রেসার মনিটরিং সিস্টেম, লেন ডিপার্চার ওয়ার্নিং, নাইট ভিশন সিস্টেম, ব্লাইন্ড স্পট ডিটেকশন, ড্রাইভার মনিটরিং, লেন কিপিং এসিস্ট্যান্স, ড্রাউজিনেস ডিটেকশন সিস্টেম, ইন্টেলিজেন্ট স্পিড এসিস্ট্যান্স ইত্যাদি।
উপরোক্ত সবগুলো সিস্টেম নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করবো। এই লেখাতে শুধুমাত্র অটোনোমাস এমার্জেন্সি ব্রেকিং নিয়ে আলোচনা করবো যেটি এক্টিভ সেফটি সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ন একটি উদাহরন।
অটোনোমাস এমার্জেন্সি ব্রেকিং সিস্টেম এমন এক প্রকার ব্রেক সিস্টেম যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। সেন্সরের মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতা সনাক্ত করে এবং যদি চালক কোনো পন্থা না নেয়, সেক্ষেত্রে দ্রুততার সাথে গাড়িকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে থামিয়ে দূর্ঘটনা প্রতিরোধ করে। অথবা যদি গাড়ি এমন অবস্থায় থাকে যখন দূর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব না, তখন অটোনোমাস এমার্জেন্সি ব্রেকিং সিস্টেম গাড়ির স্পিড কমিয়ে হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কমাতে সচেষ্ট হয়।
এক্টিভ সেফটি সিস্টেম গাড়ির সেফটি সিস্টেমের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ন, এবং হতাহতের সংখ্যা হ্রাসে এবং দূর্ঘটনা প্রতিরোধে অনেক অবদান রাখে। বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে এক্টিভ সেফটি নিয়ে গবেষনা ও কাজ করার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করবো। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এক্টিভ সেফটি সিস্টেমগুলো আরও উন্নত হবে ও দূর্ঘটনা প্রতিরোধে লক্ষণীয় ভূমিকা পালন করবে।