সোজা কথায় বলতে গেলে মাইলেজ হলো ১ লিটার ফুয়েল এ মোটরসাইকেল কত কি.মি চলতে পারে তার দক্ষতা। যত কম ফুয়েল এ যত বেশী কি.মি. চলতে পারবে ততই রাইডারের মনে বসন্তের বাতাস বহে। চলতে চলতে কোনো একদিন যদি দেখা যায় মাইলেজ কমে গেছে , তাহলে সেই বসন্তের হাওয়া যেন গ্রীষ্মের তাপদাহের ন্যায় লাগে। বলছিলাম মাইলেজ সমস্যা নিয়ে, অধিকাংশ রাইডাররাই মাইলেজ কমে গেলে হুটহটা মেকানিকদের কাছে যেয়ে কার্বুরেটর টিউনিং করাতে চান। এটা খুবই কম একটা কালচার হয়ে গেছে অনেক রাইডারদের জন্য। তবে আমরা এই লেখায় লজিক্যালি বোঝার চেষ্টা করবো মাইলেজ কমার কারণ গুলো কি কি ? এবং কিভাবে মাইলেজ ঠিক রাখা যেতে পারে।
প্রথমত আপনাদের একটা বিষয় লজিক্যালি চিন্তা করতে হবে যে ইঞ্জিন কিভাবে শক্তি উতপন্ন করে এবং সেই শক্তি কিভাবে চাকা পর্যন্ত যায় ।
ইঞ্জিনকে আমরা একধরণের মেশিন বলি যার কাজই হচ্ছে ফুয়েলকে পুড়িয়ে শক্তি উতপন্ন করা। সাধারণত এয়ার ফিল্টার এর মাধ্যমে যে পরিষ্কার বাতাস ইঞ্জিন প্রবেশ করে তা ইঞ্জিনের সিলিন্ডারে প্রবেশ করার একটু আগেই কাবুরেটরের সাহায্যে ফুয়েল নিয়ে , বাতাস এবং ফুয়েলের একটি মিশ্রণ তৈরী করে এবং সেই মিশ্রণ ইঞ্জিনের সিলিন্ডারে প্রবেশ করে।
সিলিন্ডারে প্রবেশ এর পর পিস্টন এই বাতাস এবং ফুয়েল এর মিশ্রণকে সংকোচন করতে থাকে এবং সংকোচনের ফলে এই মিশ্রণটিতে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে স্পার্ক প্লাগ স্পার্ক করলে মিশ্রণটিতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের কারণে বিস্ফোরণ হয় এবং সেই বিস্ফোরণের ধাক্কায় পিস্টন নিচের দিকে সজোরে নামতে থাকে। পিস্টন নিচের দিকে নামার ফলে ক্রাংকশ্যাফট ঘুরতে থাকে এবং এই ঘূর্ণন শক্তি ক্লাচ এবং গিয়ারবক্সের সাহায্যে চেইন স্প্রোকেট এবং অতপর চাকাকে ঘুরায়।
এখন প্রশ্ন হলো এই শক্তি উতপন্ন হতে কোন কোন বিষয়গুলো দায়ী?
১. বাতাস এবং ফুয়েল এর সঠিক মিশ্রণ
২. পিস্টনের সংকোচন চাপ বা কম্প্রেশন প্রেশার
৩. স্পার্ক প্লাগের সঠিক স্পার্ক
যদি তিনটির একটিতেও গড়বড় থাকে তাহলে ইঞ্জিন সঠিকভাবে সঠিক উতপন্ন করতে পারবে না। যদি ইঞ্জিন এর শক্তি অপচয় হয় তাহলে মোটরসাইকেল ও বেশী দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবে না। ফুয়েল অপচয় হবে তাই ফুয়েল খরচ ও বাড়বে।
আবার উপরের তিনটা বিষয় ঠিক থাকলেও যদি চাকা জ্যাম থাকে? তাহলে শক্তি ঠিকই ইঞ্জিন দিচ্ছে কিন্ত মোটরসাইকেল তা ব্যবহার করে আগাতে পারছে না।
ঠিক এ দুটো বিষয় বোঝাতে চেষ্টা করছি আপনাদের। যদি কখনো ফুয়েল খরচ বাড়ে তাহলে প্রথম যে দুটো বিষয় তার মধ্যে একটি হলো হয় ইঞ্জিন সঠিকভাবে শক্তি উতপন্ন করতে পারছে না অথবা ইঞ্জিন শক্তি উতপন্ন করছে ঠিক কিন্ত তা ব্যবহার করতে পারছে না। আরেকটি কারণ হতে পারে রাস্তা ঠিক নেই অথবা চালক অদক্ষ।
যাই হোক এত কথার পর আপনাদের মনের মধ্যে যে মূল প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো ফুয়েল খরচ বেশীর কারন গুলো কি কি?
আসুন পয়েন্ট টু পয়েন্ট জেনে নিই:
১. ফুয়েল : জি¦ হ্যা। ফুয়েল যদি ভালো মানের না হয়, যত্রতত্র হতে ফুয়েল নিয়ে যদি বাইক চালান তাহলে মাইলেজ পাবেন না। তাই ভালো মানের ও সঠিক রিসার্চ অকটেন নাম্বার এর ফুয়েল ব্যবহার করুন।
২. এয়ার ফিল্টার: এয়ার ফিল্টার যদি ক্লগড (জ্যাম) থাকে তাহলে যথেষ্ট বাতাস প্রবেশ করতে পারে না ইঞ্জিনে যা ফুয়েল খরচের অন্যতম বড় একটি কারণ। তাই সময়মতো এয়ার ফিল্টার পরিবর্তন করুন।
৩. স্পার্ক প্লাগ: স্পার্ক প্লাগের একটি হিটরেঞ্জ থাকে যা প্লাগের গায়েই লেখা থাকে। বাইকের জন্য প্রত্যেকটি ম্যানুফ্যাকচারাররাই নির্দিষ্ট হিটরেঞ্জ এর স্পার্ক প্লাগ রিকোমেন্ড করে। অনেক বাইকররা এটা জানেন না। বেশীরভাগ লোকাল মেকানিকরাই এ বিষয় সম্পর্কে অবগত নয়। তাই যেন তেন প্লাগ ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। আপনার বাইকের ম্যানুফ্যাকচারারদের দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী স্পার্ক প্লাগ ব্যবহার করুন। এবং অবশ্যই সময়মতো প্লাগ পরির্তন পরিষ্কার এবং নির্ধারিত ইলেক্ট্রোড গ্যাপ বজায় রাখুন।
৪. ট্যাপেট সেটিং: ট্যাপেট যদি নির্ধারিত পরিমাপের কম বা বেশী সেটিং করা হয় , তাহলেও ফুয়েল খরচ বেশী হয়। অবশ্যই ম্যানুফ্যাকচারার কতৃক নির্ধারিত পরিমাপের ট্যাপেট সেট করুন।
৫. কার্বুরেটরের আইডেল আরপিএম: কার্বুরেটরের আইডেল আরপিএম ম্যানুফ্যাকচারারদের গাইডলাইন অনুসারে রাখুন। অনেকের ধারণা আইডেল আরপিএম কম রাখলে ফুয়েল খরচ কম হয়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এটা করলে প্রচুর স্টার্ট সমস্যা দেখা দেয়। তাই টেকোমিটারের সাহায্যে নির্ধারিত আইডেল আরপিএম এ টিউনিং করতে হবে।
৬. ক্লাচ, ব্রেক, থ্রটল ফ্রি প্লে : অনেকেই এ বিষয়টিকে খুব হালকা ভাবে নেন। অথচ ফ্রি প্লে যদি সঠিক না হয় তাহলে থ্রটল রেসপন্স , ব্রেক ডিসটেন্স , ক্লাচিং ঠিক মত হয় না। যা ফুয়েল খরচ বৃদ্ধি করে।
৭. চেইনের স্লাকনেস: চেইনের স্লাকনেস যদি সঠিক গ্যাপ এ রাখা না হয় এবং চেইন যদি গিয়ার অয়েল দ্বারা লুব করা না হয় তাহলেও ফুয়েল খরচ বাড়তে পারে।
৮. টায়ার প্রেসার : টায়ারের হাওয়ার প্রেসার সঠিক রাখতে হবে নতুবা ফুয়েল খরচ বেড়ে যাবে।
৯. কম্প্রেশন প্রেসার : ইঞ্জিন সিলিন্ডারের কম্প্রেশন প্রেসার যদি লিক করে তাহলেও ফুয়েল খরচ বেড়ে যায়।
উপরের নয়টি পয়েন্ট থেকে দেখা যায় যে মাইলেজ কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে শুধু কার্বুরেটর নয় আরো অনেক বিষয় জড়িত । একবার কার্বুরেটর খোলা মানে আপনার সময় , অর্থ দুটোই জলে, যদি আপনি অন্যান্য বিষয় গুলো চেক না করে কার্বুরেটওে হাত দেন। তাই মাইলেজ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে ভালো কোনো ওয়ার্কশপে প্রত্যেকটা পয়েন্ট চেক করুন ।