ভূমিকা
একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির ক্রমবিকাশে আমরা যা যা পাচ্ছি, তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হলো রাইডশেয়ারিং। যারা রাইডশেয়রিং করে থাকে, তাদের কে রাইডশেয়ারিং কোম্পানি বলে। প্রশ্ন হলো রাইডশেয়ারিং কি?
রাইডশেয়ারিং
রাইডশেয়ারিং হলো এমন এক পন্থা, যেখানে ওয়েবসাইট বা এপের মাধ্যমে গাড়ী ও যাত্রীর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে। একজন যাত্রী কোথাও যাবেন, যাওয়ার আগে রাইডশেয়ারিং কোম্পানির ওয়েবসাইট বা এপে তার অবস্থান এবং গন্তব্যস্থল প্রদান করার পর সেই এপ বা ওয়েবসাইট যাত্রীর আশেপাশে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে গাড়ি খুজতে থাকে যারা রাইডশেয়ারিং এর সাথে জড়িত। রাইডশেয়ারিং এর গাড়িগুলোর চালকের মধ্য থেকে যে রাইড পিক করবে, রাইডশেয়ারিং কোম্পানির ওয়েবসাইট বা এপ সেই গাড়ির সাথে যাত্রীর যোগাযোগ স্থাপন করে দিবে। গাড়িটি তখন যাত্রির অবস্থানে এসে পৌছে যাত্রীকে নিয়ে তার গন্তব্যে পৌছে দিবে। রাইডশেয়ারিং কোম্পানি মূলত এভাবেই কাজ করে। তারা যাত্রী ও গাড়ির মধ্যে সেতুর মত কাজ করে।
রাইডশেয়ারিং এর সুবিধা হলো যেসকল এলাকাতে যাত্রী কম বা সাধারনত প্রচলিত ট্যাক্সিগুলো সার্ভিস প্রদান করেনা, সেখানেও রাইডশেয়ায়রিং কোম্পানিগুলো সার্ভিস প্রদান করে থাকে। বর্তমানে প্রচলিত ট্যাক্সি সার্ভিসের চেয়ে অনেক বেশী জনপ্রিয়তা পেয়েছে বিভিন্ন রাইডশেয়ারিং কোম্পানিগুলো, যাদের মধ্যে লিফট, গ্র্যাব, উবার অন্যতম। এছাড়া, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজস্ব অনেক রাইডশেয়ারিং কোম্পানি রয়েছে। যেমন বাংলাদেশে উবারের পাশাপাশি দেশীয় রাইডশেয়ারিং কোম্পানি পাঠাও, সহজ, ওভাই, পিকমি ইত্যাদি রয়েছে।
বর্তমানে রাইডশেয়ারিং কোম্পানি ভিন্ন ধরনের ট্যাক্সি সার্ভিসে প্রদানের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখছে।
রাইডশেয়ারিং এর ইতিহাস
প্রচলিত ট্যাক্সি সার্ভিসের রেন্ট এ কার সার্ভিস অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিলো এদেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে। রেন্ট এ কার সার্ভিস কেও একধরনের রাইডশেয়ারিং সার্ভিস আমরা বলতে পারি। তাছাড়া, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে আগে থেকেই লিফট দেওয়ার একটা প্রথা চালু ছিলো। কাউকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গাড়িতে করে কিছুদূরে ড্রপ করে দিতো। তবে আক্ষরিক অর্থে যদি রাইডশেয়ারিং কোম্পানি বা সার্ভিসের কথা চিন্তা করি, সেক্ষেত্রে, রাইডশেয়ারিং এর যাত্রা শুরু ২০০৯ সালে উবারের মাধ্যমে। উবার একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান যার মূল কার্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ফ্রান্সিস্কো তে অবস্থিত এবং বর্তমানে বিশ্বের ৭৮৫টিরও বেশি শহরে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস প্রদান করে আসছে। ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ১১ কোটির বেশি লোক উবার ব্যবহার করছে। ২০০৯ সালে গ্যারেট ক্যাম্প নামের একজন প্রোগ্রামার ট্রাভিস কালানিক নামের একজনের সাথে উবার শুরু করেন “উবার ক্যাব” নামে। কিন্তু শুরুটা কিভাবে? ২০০৯ এর প্রথম দিনে ক্যাম্প ও তার বন্ধুরা ৮০০ মার্কিন ডলার বেতনে একজন ড্রাইভার নিয়োগ দেন। কিন্তু ক্যাম্প চিন্তা করছিলেন কিভাবে পরিবহন যাত্রার খরচ কমানো যায় তা নিয়ে। তিনি উপলব্ধি করলেন, যাতায়াতের সময়ে যাতায়াতের মোট খরচ যদি কয়েকজন মিলে ভাগ করে দেয়, সেক্ষেত্রে, গাড়িতে চড়া বা উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা উপভোগ করা অনেকের পক্ষেই সহজ হবে। এই উপলব্ধি থেকেই উবারের জন্ম। পরীক্ষামূলকভাবে ২০১০ এর মে তে উবারের মোবাইল এপ যাত্রা শুরু করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় ২০১১ তে। সেই সময়ে উবার দিয়ে একজন যাত্রী কালো রঙ এর বিলাসবহুল গাড়ি ভাড়া নিতে পারতেন যার ভাড়া ছিলো আমেরিকার ট্যাক্সি ভাড়ার প্রায় দেড়গুন বেশি। ২০১১ সালে উবার ক্যাবের নাম পরিবর্তন করে শুধু উবার রাখা হয়। ২০১২ সালে উবার উবার এক্স চালু করে, যা দিয়ে যাত্রীরা কমভাড়ায় তুলনামূলক কম বিলাসবহুল গাড়ি ভাড়া করতে পারতো। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে উবার চালু করে উবারপুল।
উবারের মত আরও কয়েকটি জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক রাইডশেয়ারিং কোম্পানি হলো Grab, Lyft, Careem ইত্যাদি। Grab একটি সিংগাপুরভিত্তিক রাইডশেয়ারিং কোম্পানি যা ২০১২ এর জুন মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া, Lyft প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৬৪৪ টি শহরে Lyft তাদের রাইডশেয়ারিং সার্ভিস প্রদান করে আসছে। Careem দুবাই ভিত্তিক কোম্পানি যা প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১২ এর মার্চে। Careem মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাইডশেয়ারিং সার্ভিস প্রদান করে আসছে।
Careem পাকিস্তানে মহিলা চালক নিয়োগ দেয়। এছাড়া, সৌদি আরবে Careem এর মোট যাত্রীর প্রায় ৮০% যাত্রীই নারী। সম্প্রতি সৌদি আরবে নারীরা ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছে বিধায়, Careem ২০২০ সাল নাগাদ প্রায় ২০০০০ নারী চালক নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
বাংলাদেশে রাইডশেয়ারিং এর শুরু
বাংলাদেশে অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন, আর যারা করেননা, তারা দৈনন্দিন জীবনে যাতায়াতের জন্য লোকাল বাস, সিএনজি, রিকশা, রেন্ট এ কার এর গাড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করেন। কিন্তু রেন্ট এ কারের খরচ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাছাড়া, লোকাল বাস বা রিকশায় খরচ কম হলেও, যাতায়াত আরামদায়ক হয়না অনেক সময়েই আর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা তো অনেক ক্ষেত্রেই থাকেনা। সিএনজি তুলনামূলক আরামদায়ক হলেও তারা নিয়ম মেনে চলেনা এবং মিটারে না গিয়ে নিজের মত ভাড়া দাবি করে যাত্রীদের কাছে, যা হয়রানির শামিল। এরকম সময়েই ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের প্রথম দেশী রাইডশেয়ারিং কোম্পানি “পাঠাও”। শুরুতে মোটরসাইকেল দিয়ে তাদের রাইডশেয়ারিং শুরু করলেও এখন গাড়ী, মোটরসাইকেল সব দিয়ে তারা রাইডশেয়ারিং সার্ভিস প্রদান করছে। ২০১৬ এর নভেম্বরে বাংলাদেশে আসে উবার। এরপর থেকে মূলত অনেকেই উবার, পাঠাও ইত্যাদি রাইডশেয়ারিং সার্ভিস ব্যবহার করছেন। মেহরাব মাসাঈদ হাবিব নামের একজন উবার ব্যবহারকারী জানান, ছেলেবেলা থেকেই বাড়িতে গাড়ি ছিলো তাদের। হঠাত করেই নানা কারনে পরিবার গাড়ি ব্যবহার করা থামিয়ে দেয় এবং তখন থেকে তাকে দৈনন্দিন যাতায়াত কাজে রিকশা, লোকাল বাস ব্যবহার করতে হয়। যেহেতু কখনো লোকাল বাসে চড়ার অভ্যাস ছিলোনা, তাই খুব অসুবিধা হতো তার জন্য আর যাতায়াতও কষ্টদায়ক ও ক্লান্তিকর হতো তার জন্য। এরপর ২০১৬ তে উবার আসার পর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে উবার ব্যবহার করেন, তুলনামূলক কম খরচে আরামদায়ক যাতায়াত করেন।
এছাড়া বাংলাদেশে উবার, পাঠাও ছাড়াও আরও কিছু স্থানীয় রাইডশেয়ারিং কোম্পানি রয়েছে, যেমন, Obhai, Piickme, Shohoj ইত্যাদি, যারা বিশ্বের স্বনামধন্য রাইডশেয়ারিং কোম্পানির মতই উন্নত সার্ভিস প্রদান করে আসছে।