ভূমিকা
অটোমোবাইলে দুই ধরনের সেফটি সিস্টেম থাকে। সেফটি সিস্টেমগুলো হলো এক্টিভ সেফটি সিস্টেম এবং অন্যটি প্যাসিভ সেফটি সিস্টেম। এক্টিভ সেফটি সিস্টেম সম্পর্কে পূর্ববর্তী ব্লগে আলোচনা করা হয়েছে। এই ব্লগে আমি প্যাসিভ সেফটি সিস্টেম নিয়ে আলাপ করবো।
আগেই জেনেছি এক্টিভ সেফটি সিস্টেম কাজ করে দূর্ঘটনার আগে। মূলত দূর্ঘটনা প্রতিরোধ করাই এক্টিভ সেফটির কাজ। অন্যদিকে প্যাসিভ সেফটি কাজ করে দূর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে।
প্যাসিভ সেফটি সিস্টেমের উদ্দেশ্য
ধরুন আপনি গাড়ি চালিয়ে লংড্রাইভে এসেছেন। আপনার নতুন মডেলের গাড়ি এবং এতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রায় সবই রয়েছে। এক্টিভ সেফটি সিস্টেমের সকল প্রযুক্তিই রয়েছে আপনার গাড়িতে। হঠাৎ সামনে একটি ট্রাক দেখতে পেলেন যা অপর দিক থেকে আসছে আপনার দিকে। দূর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু না। আপনার গাড়িতে থাকা এক্টিভ সেফটি সিস্টেম গতি, দিক সব নিয়ন্ত্রনে নিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দূর্ঘটনা থেকে আপনার গাড়িকে প্রতিহত করলো, আপনিও বেচে গেলেন। কিন্তু যদি গাড়িতে এক্টিভ সেফটি সিস্টেমের প্রযুক্তিগুলো না থাকতো, বা কাজ না করতো, অথবা যদি আপনি নিজে গাড়িকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলেননা, সেক্ষেত্রে তো দূর্ঘটনা ঘটেই যেত। কি হতো তখন? আপনার গাড়ি কে দূর্ঘটনার প্রভাব থেকে দূরে রাখা বা আপনার বা যাত্রীর নিরাপত্তা কি অসম্ভব হয়ে যেত? মোটেই না।
কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে গাড়ির উপর দূর্ঘটনার প্রভাব কমাতে এবং যাত্রীকে বাচাতে ও হতাহতের সংখ্যা হ্রাস করতে প্যাসিভ সেফটি সিস্টেম কাজ করে। প্যাসিভ সেফটি সিস্টেম কে সেকেন্ডারী সেফটি সিস্টেমও বলা হয়।
প্যাসিভ সেফটি সিস্টেমের উদাহরন
তিন ধরনের প্যাসিফ সেফটি সিস্টেম রয়েছে বর্তমানে। এগুলো হলো - এয়ারব্যাগ, সিটবেল্ট ও ডিফর্মেশন জোন। নিম্নে এই তিনপ্রকার প্যাসিভ সেফটি সিস্টেম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
এয়ারব্যাগ
গাড়ি এক্সিডেন্ট করলে গাড়ির কোন কিছুকে থামাতে অনেক বড় পরিমান বল প্রয়োগ করতে হয়। কারন, সংঘর্ষ ঘটলে গাড়ির ভরবেগ মুহুর্তে পরিবর্তন হয় যা গাড়ির যাত্রীর হয়না। এর কারন হল, অপর্যাপ্ত সময়। এই অপর্যাপ্ত সময়ে বল প্রয়োগের মাধ্যমে যতটা সম্ভব কম ক্ষতি করার মাধ্যমে যাত্রীর ভরবেগ থামিয়ে দেয় এক প্রকারের সিস্টেম যাকে রেস্ট্ররেইন্ট সিস্টেম বলে।
এয়ার ব্যাগ এমনই একটি রেস্ট্রেইন্ট সিস্টেম। এয়ার ব্যাগ এর কাজ হল যাত্রীর কোন ক্ষতি না করে তাদের ভরবেগ একদম কমিয়ে ফেলা। তবে, এই জন্য এয়ার ব্যাগ কে অনেক শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, যা এক কথায় অনেক বেশী। সাধারনত স্টিয়ারিং হুইল ও ড্যাশবোর্ডের ভিতরে এয়ার ব্যাগ থাকে এবং গাড়ির সংঘর্ষ হলে এই এয়ারব্যাগ কার্যকর হতে সময় লাগে খুবই সূক্ষ ভগ্নাংশ সেকেন্ড।
একটি এয়ারব্যাগের তিনটি অংশ রয়েছে। যথা-
• ব্যাগ
• সেন্সর
• কেমিক্যাল বা রাসায়নিক
ব্যাগ
এয়ারব্যাগের প্রধান অংশ হল এই ব্যাগ। হালকা নাইলন ফেব্রিক্স দিয়ে তৈরী এই ব্যাগ ভাজ করে স্টিয়ারিং উইল বা ড্যাশবোর্ডের ভিতর রাখা থাকে। গাড়ির সংঘর্ষ ঘটা মাত্রই ৪০ মিলিসেকেন্ড এর মধ্যে সম্পুর্নরূপে ফুলে ওঠে। এই ব্যাগ ৮০ থেকে ১০০ মিলিসেকেন্ডের মধ্যে বাতাস বের করে দেয় যার ফলে হতাহতের সম্ভাবনা প্রায় থাকেনা বললেই চলে। এয়ারব্যাগ ব্যবহারের ফলে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। এয়ারব্যাগ না থাকলে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশী হত এবং তাৎক্ষনিক মৃত্যুও হত। নিম্নে একটি এয়ারব্যাগ ফুলে ওঠার চিত্র তুলে ধরা হল।
সেন্সর
সেন্সর মাইক্রোচিপের মাধ্যমে সংঘর্ষের তথ্য সংগ্রহ করে। গাড়ির কোন সংঘর্ষ হলে বৈদ্যুতিক সংযোগ এর একটি সুইচ সেন্সর কে গাড়ী সংঘর্ষের তথ্য পাঠায় এবং সেন্সর তখন এয়ারব্যাগ কে ফুলে ওঠার নির্দেশ দেয়।
কেমিক্যাল বা রাসায়নিক
গাড়ি সংঘর্ষের ফলে এয়ারব্যাগ যে ফুলে ওঠে, তা সম্ভব হয় এয়ারব্যাগে কিছু রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের মাধ্যমে। এয়ারব্যাগে সোডিয়াম এজাইড (NaN3) ও পটাশিয়াম নাইট্রেট (KNO3) বিক্রিয়ার মাধ্যমে নাইট্রোজেন গ্যাস তৈরী হয় যা এয়ারব্যাগ কে ফোলায়। এয়ারব্যাগ সিস্টেম মূলত এক প্রকার বিস্ফোরক পদার্থকে প্রজ্জ্বলিত করে যা অনেক দ্রুত এয়ারব্যাগ কে ফোলানোর জন্য নাইট্রোজেন গ্যাস তৈরী করে।
সিটবেল্ট
সিটবেল্ট চেনেনা এমন মানুষ পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করিনা। গাড়ি ও যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরনে সিটবেল্ট গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। এছাড়া, দূর্ঘটনা ঘটলে হতাহতের হার কমাতে এমনকি যাত্রীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাচাতেও অনেক বড় ভূমিকা পালন করে সিটবেল্ট। সিটবেল্ট পড়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আইন রয়েছে। এছাড়া, সিটবেল্ট না পড়লে অনেক দেশেই জরিমানার টাকা গুনতে হয় যাত্রীকে। তাহলেই বুঝুন, সিটবেল্ট পড়ার উপকারিতা কত বেশি।
যদি যাত্রী সিটবেল্ট না পড়েন, তাহলে দূর্ঘটনা ঘটলে তিনি স্টিয়ারিং, ড্যাশবোর্ডে ধাক্কা খেয়ে ব্যাথা পেতে পারেন এমনকি মাথাও ফেটে যেতে পারে, এমনকি এর ফলে মৃত্যুও ঘটতে পারে। এছাড়া হাত পা ভাংগার আশংকাও থাকে যদি সিটবেল্ট না পড়া অবস্থায় গাড়ি দূর্ঘটনার কবলে পড়ে। এগুলোর আশংকা অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব যদি যাত্রী সিটবেল্ট পড়েন। দূর্ঘটনার ফলে হতাহতের সংখ্যা হ্রাসে সিটবেল্ট গত কয়েক দশকে গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখেছে। সিটবেল্ট যাত্রীকে নির্দিষ্ট অবস্থানে আটকিয়ে রাখে এবং ভারসাম্য রক্ষা করে। এতে করে, দূর্ঘটনা ঘটলে যাত্রী বা চালক একই অবস্থানে আটকে যান সিটবেল্টের কারনে এবং ধাক্কা খাওয়া থেকে রক্ষা পান।
ডিফর্মেশন জোন
ডিফর্মেশন জোনকে ক্রাম্পল জোনও বলে। দূর্ঘটনার ফলে যাত্রীকে আহত হওয়া থেকে বাচাতে ডিফর্মেশন জোনের অবদান কম নয়। ব্যালা বাড়োনি নামের মার্সিডিসে কর্মরত একজন ইঞ্জিনিয়ার ১৯৩৭ সালে ডিফর্মেশন জোন উদ্ভাবন করেন। তাকে প্যাসিভ সেফটির জনকও বলা হয়। তাকে নিয়ে সামনে কোনো সময়ে একটা লেখা লেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম।
সাধারনত গাড়ির সামনের দিকে একটি নির্দিষ্ট অংশ রাখা হয় যাকে ডিফর্মেশন জোন বলে, ডিফর্মেশন জোনের কাজই হলো দূর্ঘটনার পর ডিফর্ম করা বা আকারের বিকৃতি ঘটানো। যারা ফিজিক্স পড়েছেন,তারা জানেন, দূর্ঘটনার ফলে গাড়ি শক্তি বা এনার্জি এবজর্ব করে এবং এই এবজর্বের কাজ করে ডিফর্মেশন জোন। দূর্ঘটনার ফলে যে পরিমান এনার্জি সৃষ্টি হয় তা গাড়ি এবং যাত্রীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করতে পারে। ডিফর্মেশন জোন গাড়ির একটি নির্দিষ্ট অংশ যা এনার্জি এবজর্ব করে নিয়ে নিজের আকার বিকৃতি করে এবং গাড়িকে এবং গাড়ির ভেতরের যাত্রীদের কে রক্ষা করে।
গত কয়েক দশকে প্যাসিভ সেফটি সিস্টেম গাড়ির দূর্ঘটনায় এর প্রভাব থেকে গাড়িকে রক্ষা করতে এবং যাত্রীর হতাহতের সংখ্যা অনেক অবদান রেখেছে। একারনে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নির্মিত গাড়িগুলো ক্রাশ টেস্টে অধিক স্কোর অর্জনে সক্ষম হয়েছে এবং সেই সাথে প্যাসিভ সেফটিরও ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছে। প্যাসিভ সেফটি সিস্টেম বর্তমানে ও ভবিষ্যতে সবসময়েই প্রতিটি গাড়িতেই থাকবে এবং দূর্ঘটনার প্রভাব থেকে গাড়ীকে অনেকটাই রক্ষা করবে। তবু এতকিছুর পরেও একটি বিষয় না বললেই নয়, তা হলো যাত্রী সিটবেল্ট না বাধলে প্যাসিভ সেফটি সিস্টেম কার্যকর হবেনা। এজন্য প্রত্যেকের উচিত গাড়িতে উঠেই সিটবেল্ট বেধে নেওয়া, যতদূরেই যাওয়া হোকনা কেন।