uncategorized

ইঞ্জিন তাপ নিয়ন্ত্রণে অয়েল কুলার

ভুমিকা কথনঃ

আমরা যখন হাতের তালুকে ঘষা দেই হাতের তালু কি হয়?একটু ভেবে দেখেন তো এর পিছনে বিজ্ঞানটা কি?

আমরা যখন হাতের তালুকে ঘষা দেই তখন হাত অত্যন্ত গরম হয়ে যায়।আরও যদি ঘষা দেই একসময় দেখা যাবে আমাদের হাত তার বল পাচ্ছে না। অবশ হয়ে যাচ্ছে।এর পিছনে মূল বিজ্ঞানটা হলো ঘর্ষন। ঠিক এমনই এক ঘটনা আমরা দেখতে পাই ইঞ্জিনে। গাড়ি যখন বহুক্ষন, বহু গরম আবহাওয়াতে আমরা ব্যবহার করি তখন আমাদের ইঞ্জিন অয়েল অত্যাধিক গরম হয়ে যায়। তখন সেটি ইঞ্জিনের ভিতরে থাকা সমস্ত পার্টসগুলোতে আরো বেশী ঘর্ষনের সৃষ্টি করে।অত্যাধিক গরম এবং ঘর্ষনের জন্য হাতের তালুর মতো ইঞ্জিনের পার্টসগুলোও অকেজো হয়ে পড়ে, ক্ষয় হয়ে যায়। আরও সাবলীলভাবে বললে, ইঞ্জিন অয়েল যখন গরম হয় তখন এটি আরো পাতলা হয়ে যায়।যার ফলে ইঞ্জিনের সব পার্টসে ঘর্ষনের মাত্রাটাও বেড়ে যায়। তাই এ সমস্যা দূর করে ইঞ্জিন কুলার বা রেডিয়েটর। এর পিছনে শুধু যে রেডিয়েটরের ভুমিকা আছে তা কিন্তু নয়। এর পিছনে রয়েছে আরো কিছু রহস্য। আমরা সেটাই আজ সুন্দর সাবলীল চিন্তাধারার মাধ্যমে শিখবো।

ইঞ্জিন অয়েল কুলার কি?

আমরা যখন হালকা গরম একটি পাতিলকে ধরি,তখম গরম পাতিলের গরমটা অনুভব করি। অনেকক্ষন ধরে রাখলে দেখা যাবে,আমাদের হাতও গরম হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আগের মতো গরমটা আর অনুভব করছি না! এখানে ঘটনাটা কি ঘটলো একটু ভাবুন তো!

মুলত আমরা যখন গরম পাতিলকে ধরছি তখন গরম পাতিল হতে গরমটা আমাদের শরীরে ঠান্ডা অবস্থাকে দুরে সরিয়ে দিচ্ছে।কারন তাপের ধর্মই হলো তাপ সর্বদা উচ্চ তাপমাত্রা হতে নিম্ন তাপমাত্রায় গমন করে। ইঞ্জিন কুলারও ঠিক একই মেকানিজম মেনে চলে।

ইঞ্জিন কুলার মুলতো একটি হিট এক্সচেন্জ্ঞার। এটি শীতলকারী পদার্থ বা কুলেন্ট ব্যবহার করে গরম তেলকে ঠান্ডা করে। এই কুলেন্ট বাতাস বা তরল উভয় ভাবেই হতে পারে। সাধারনত এই কুলেন্ট, ইঞ্জিন অয়েলের থেকেও দ্রুত গতিতে ইঞ্জিনের অপারেটিং তাপমাত্রায় পৌছায়। যার ফলে এটি সহজেই গরম, ঠান্ডা উভয় মৌসুমেই গরম তেলকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। যদি বায়ু কুলেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবে এই অয়েল কুলার অবশ্যই আগত বায়ুর সম্মুখ করে রাখতে হবে, যাতে বায়ু খুব সহজেই এর মধ্যে চলাচল করে। প্রয়োজনে একটি ফ্যানও ব্যবহার করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, বায়ু ধাক্কার থেকে টানা যথার্থ।

অয়েল কুলার কি সব ধরনের অটোমোবাইলে ব্যবহার উপযোগী?

অয়েল কুলার একটি ইঞ্জিনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা মডার্ন কার, ট্রাক, SUV কে প্রতিদিন রাস্তাঘাটে স্বচ্ছন্দভাবে চলতে সহায়তা করে। বর্তমানে ট্রান্সমিশন, কুলার এর একটি নতুন রুপ। এখন অয়েল কুলার কোন কারনে নষ্ট হয়ে গেলে কি হবে? অয়েল কুলার যথাযথভাবে কাজ না করলে অতিরিক্ত চাপ কুলেন্টকে সিস্টেম থেকে অয়েল প্যানে নিয়ে আসে। যেটা মোটেও মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। যার জন্য ইঞ্জিনে ক্ষতি হয় এবং ইঞ্জিন খুব দ্রুত অচল হয়ে পড়বে যদি তা মেরামত না করা হয়।

অয়েল কুলার কি ইঞ্জিনের ক্ষমতা বাড়ায়?

অয়েল কুলার ইঞ্জিনের ক্ষমতা না বাড়ালেও এটি ইঞ্জিনের ক্ষমতা হ্রাস করে,কারন পাতলা অয়েল ইঞ্জিনের পার্টসে ঘর্ষন বাড়ায়,যা ইঞ্জিনকে অচল করে দেয়,যা কেবল ইঞ্জিন কুলারই সমাধান করতে পারে।

ইঞ্জিন কুলারের প্রকারভেদ?

বর্তমানে ব্যবহারের ভিত্তিতে ইঞ্জিন কুলার ২ ধরনের।

বান্ডেল টাইপ অয়েল কুলারঃ সাধারনত একটি হাউজিং এ সিলিন্ডার আকৃতির টিউব বান্ডেল ও হেডারের সমন্বয়ে এটি গঠিত। ইঞ্জিন কুলেন্ট এই বান্ডেল দিয়ে পরিবাহিত হয় এবং ইঞ্জিন অয়েল স্পাইরালি টিউবের চারপাশে পরিবাহিত হয় হ্যালিক্যাল বাফেলের সাহায্যে। এই গঠনে তেল এবং কুলেন্ট এর পরিবহনের দিক বিপরীতমুখী(কাউন্টার পরিবহন)। অর্থাৎ ইঞ্জিন অয়েল প্রথমবার তখনই কুলেন্টের সংস্পর্শে আসে যখন সেটি অত্যন্ত গরম থাকে এবং কুলেন্টটি অত্যন্ত ঠান্ডা থাকে।

বান্ডেল টাইপ অয়েল কুলার

ইন দ্যা প্লেট টাইপ অয়েল কুলারঃ সাধারনত এ টাইপের কুলারে অয়েল অনেকগুলি ফ্ল্যাট প্লেটের ভিতর দিয়ে পরিবাহিত হয় এবং কুলেন্ট সেটির চারপাশে পরিবাহিত হয় হাউজিং অ্যাসেম্বলের মধ্যে। যদিও একটি মজার ব্যপার হলো এর কর্মদক্ষতা বান্ডেল টাইপ অয়েল কুলার হতে কম। তবে, এর সাশ্রয়ীতা, সহজে পরিষ্কারের সুবিধা, সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্যতা এবং নিবিড় গঠন অনেক ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে একে পছন্দনীয় করে তুলেছে।

ইন দা প্লেস টাইপ অয়েল

পিস্টন অয়েল কুলিং নোজেলঃ

এটি সাধারনত বড় ধরনের ইন্জিনে ব্যবহার করা হয় যার বেধ >১০০ মি.মি.। এটি পিস্টনের নিচের অংশে অবস্থান করে লু্ব্রিকেশন অয়েল স্প্রে করে, যার কারনে পিস্টন খুব সহজেই ইন্জিন সিলিন্ডারে চলাচল করতে পারে। এর ব্যবহার আধুনিক ইঞ্জিনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্প্লেশ লুব্রিকেশনের সিস্টেম দিয়েও মোটামুটি একই কাজ করা যেত,তবে নানা সমস্যার জন্য এর ব্যবহার এখন আর পরিলক্ষিত নয়। একটি বিষয় অত্যাধিক লক্ষনীয় সেটি হলো পিস্টনে এর সঠিক স্থাপনা। এর ভুল স্থাপনা পিস্টনকে অতিরিক্ত গরম করে অগ্নিসংযোগ ঘটাতেও সক্ষম।

লুব্রিকেশন অয়েলের চাপ পরিচলন/কন্ট্রোলঃ

ভেরিয়েবল ক্যাপাসিটেন্স প্রেশার সেন্সর(Variable Capacitance Pressure Sensor): বর্তমানে ইলেকট্রনিক্স জগতে সেন্সরের ব্যবহার উর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে বহুল ব্যবহত একটি সেন্সর হলো ভেরিয়েবল ক্যাপাসিটেন্স প্রেশার সেন্সর-যা নিয়ে আমরা কথা বলবো যা লুব্রিকেশন অয়েলের চাপ নিয়ন্ত্রণ করে।

ইসিএম(ECM) নিয়ন্ত্রিত কমার্শিয়াল ডিজেল চালিত ইঞ্জিনে এর ব্যবহার লক্ষনীয়। স্কুলে/কলেজে আমরা নিশ্চয়ই ক্যাপাসিটেন্স টপিকটির সাথে পরিচিত হয়েছি ঠিক ওরকম ধারনার উপর ভিত্তি করে এখানেও প্রেশারের পরিবর্তনের সাথে সাথে একটি গতিশীল সিরামিক ডিস্ক, স্থির স্টিলের ডিস্কের কাছে বা দূরে চলাচল করে যার ফলে ক্যাপাসিটেন্সের পরিবর্তন ঘটে,যা ECM এ ভোল্টেজ আকারে পরিলক্ষিত হয়।উদাহরণস্বরূপ,ভোল্টেজের মান ৫ ভোল্ট থাকলে অয়েল প্রেশার অত্যাধিক বেশী কিন্তু ভোল্টেজের মান ০ ভোল্ট থাকলে অয়েল প্রেশার নিয়ন্ত্রিত।বিষয়টি খুব মজার না?

ভেরিয়েবল ক্যাপাসিটেন্স প্রেশার সেন্সর

বোর্ডেন গজ

এখন কথা হলো যেসব গাড়িতে ECM ব্যবহার করা হয় না, সেটির লুব্রিকেশন অয়েলের প্রেশার নিয়ন্ত্রণ হয় কিভাবে?

মুলত, সেখানে মেকানিকাল কোন সিস্টম অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে, যার মধ্যে একটি হলো বোর্ডেন গজ সিস্টেম। এখানে ফ্লেক্সিবল বোর্ডেন টিউব অয়েল দ্বারা পূর্ন থাকে। যখন চাপ বাড়ে এটির কয়েলগুলো মুক্ত হয়ে ওটির ভিতরেই লম্বা হয়,যা এর সাথে সংযুক্ত গিয়ারকে ঘুরায়, যেটি পরবর্তীতে একটি পয়েন্টারকে কেলিব্রেটেড স্কেলের চারপাশে ঘুরিয়ে যথার্থ চাপের পরিমাপ জানায়।

বোর্ডেন গজ

এখন তোমাদের মধ্যে চিন্তার একটি রেখা দেখা যেতে পারে এই ভেবে যে, আমরা কুলিং অয়েল ও কুলেন্ট নিয়ে পড়ছিলাম, তাহলে হঠাৎ লুব্রিকেশন অয়েলের কথাটা আসলো কোথা থেকে? চিন্তার কোন কারন নেই। কুলেন্ট মুলত ব্যবহার করা হয় উচ্চ তাপমাত্রা কমানোর জন্য, অন্যদিকে লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করা হয় ম্যাটেরিয়ালের ক্ষত,ময়লার সমস্যা দুর করে তাদের রক্ষার জন্য। লুব্রিকেন্টের অনেক ব্যবহারের মধ্যে একটি হলো যে, এটি কুলেন্ট হিসেবেও ব্যবহার করা সম্ভব। উদাহরণ দরকার? এর উদাহরন আমি তোমাদের আগেই দিয়েছি "পিস্টন অয়েল কুলিং নোজলে"।

পরিসমাপ্তি

অনেকক্ষণ তোমাদের সাথে ইঞ্জিন অয়েলের ভুবনে ঘুরে আসলাম। আশা করি, আমি তোমাদেরকে একজন ট্যুর গাইড হিসেবে এ ভুবনে আনন্দ ও জ্ঞানের সহিত ঘুরিয়ে আনতে পেরেছি। তুমি,হ্যা, তোমাকেই বলছি, ওহে ভবিষ্যতের গবেষকগন, তোমাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, এ সম্পর্কিত বর্তমানে মডিফাইড ইন্জিন কুলিং সিস্টেম, কুলেন্ট হিসেবে ন্যানোফ্লুইডের ব্যবহার ইত্যাদি মজার মজার বিষয়াদি নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষনা চলছে এবং অনেকাংশে সফলতার আলোও দেখা দিয়েছে।হ য়তো এই গবেষনার অবশিষ্ট আলোটি গায়ে মাখার দায়িত্বটি তোমাদের হাতেই ন্যাস্ত।

ইব্রাহিম খলিল অপূর্ব
লেখক সম্পর্কে
ইব্রাহিম খলিল অপূর্ব

ইব্রাহিম খলিল অপূর্ব চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের স্নাতক বর্ষের ছাত্র। তিনি গাড়ির প্রতি খুব আগ্রহী এবং হিট ট্রান্সফার, ফ্লুইড মেকানিক্স, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, অটোমোবাইলের এনালিটিকাল ও ম্যানুফ্যাকচারিং ঘরানার কাজে আগ্রহী। এছাড়া তিনি মেকানিকাল ডিজাইনের উপর একজন সার্টিফায়েড সলিডওয়ার্ক্স এসোসিয়েট। তার সিমুলেশন, পাইথন প্রোগ্রামিং এ দক্ষতা রয়েছে। এছাড়া, তিনি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে ভালোবাসেন। আমরা আশাবাদী যে ইব্রাহীম খলিল অপূর্বর অবদান বাংলা অটোমোবাইল স্কুল কে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।